নারীদের ঘরে অবস্থান করা নিয়ে আয়াত
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে (৩৩:৩৩) বলেন:
وَقَرۡنَ فِىۡ بُيُوۡتِكُنَّ وَلَا تَبَـرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِيَّةِ الۡاُوۡلٰى
এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবেনা।
এই আয়াতের মুখাতাব (সম্বোধিত) হলো নবীর স্ত্রীরা সুতরাং এই আয়াত সাধারন মহিলাদের উপর প্রযোজ্য হবেনা- এই যুক্তি আপনারা কম-বেশি শুনেছেন। আমাদের আজকের আলাপ সেইখানে না। আমাদের আজকের আলাপ হইলো, এই আয়াতের অর্থটা আসলে কী? মোটামুটি সবগুলো বাংলা অনুবাদেই আমরা দেখি এর অনুবাদ করা হয়েছে যে: আর তোমরা নিজেদের বাসায় অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবেনা।
এই অর্থে ভুল নাই, নিস:ন্দেহে। কিন্তু এর পাশাপাশি এই আয়াতের আরেকটা পুরোপুরি ভিন্ন অর্থ আছে যেটা ইসলামের ইতিহাসে অনেক বড় বড় মুফাসসির পন্ডিত গ্রহন করেছেন। অনেকে দুই অর্থকেই সম্ভাব্য অর্থ হিসেবে পাশাপাশি গ্রহন করেছেন। সেই অর্থটা ভিন্ন কেরা’আত এবং সরফ দ্বারা প্রভাবিত। নিচে এজন্য একটু টেকনিক্যাল আলাপ আসবে। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়বেন। না হলে মূল উদ্ধৃতির অনুবাদ বাদ দিয়ে আমার সংক্ষেপিত আলাপে চলে যেতে পারেন। দেখা যাক সেই অর্থটা কেমন:
তাফসীর শাস্ত্র্রের প্রধান গুরু ইবনে জারির আত-তাবারি (মৃ. হিজরী ৩১০) এই আয়াতের ব্যখ্যায় বলতেছেন: (১)
“ক্বারিরা এই আয়াত কিভাবে পড়তে হবে তা নিয়ে ইখতেলাফ করেছেন। মদীনার সাধারন ক্বারিরা এবং কুফার কিছু ক্বারিরা পড়েছেন: ওয়াকারনা (وقَرن) ফি বুয়ুতিকুন্না, যেখানে ق এর উপর জবর। এর অর্থ হলো: واقررن في بيوتكنّ (তোমাদের বাড়িতে অবস্থান করো)। এটা যারা পড়ে তারা প্রথম راء কে বিলুপ্ত করে এর যবরকে قاف এর উপর দেন। একই ভাবে বলা হয়: فظلتم تفكهون , যেটা আসলে ছিল فظللتم, যার যেরযুক্ত প্রথম لام কে ফেলে দিয়ে, এর যেরকে ظاء এর নিচে দেয়া হয়েছে।
আর কুফা এবং বসরার সব ক্বারীই এই আয়াত কে পড়েছেন: وَقِرْنَ, অর্থাৎ قاف এ যের দিয়ে। তখন এর অর্থ হবে: তোমরা তোমাদের বাড়িতে মর্যাদা, সহনশীলতা ও প্রশান্তির মানুষ হয়ে যাও। (كنّ أهل وقار وسكينة فِي بُيُوتِكُنّ)। এই ক্বিরাআত, যেটাতে قاف এর নিচে যের আছে, আমাদের কাছে অধিকতর সঠিক ( أَولى عندنا بالصواب)। কেননা এই শব্দটি যদি আমাদের দাবি মোতাবেক وقار (প্রশান্তি) থেকে হয়, তাহলে কোন সন্দেহ নাই যে এইটা قاف এর নিচে যের দিয়েই পড়া হবে। কারন: বলা হয়ে থাকে: وقر فلان في منزله فهو يقر وقورا । এ ক্ষেত্রে যখন আদেশ দেয়া হয় তখন قاف এর নিচে যের দিয়ে বলা হয় قِرّ। যেমনটা وزن-يزن (ওযন করা) থেকে আদেশমূলক হলে বলা হয় زِن। وَعد-يعِد থেকে عِد ।
আর এটা যদি প্রথম কেরাআত মোতাবেক القرار (অবস্থান) থেকে হতো, তাহলে এর মূল হতো اقررن। এটা তখন আরবরা যেমন বলে: ظلت أفعل كذا ، وأحست بكذا, এ ক্ষেত্রে ক্রিয়ার দ্বিতীয় অক্ষর (عين كلمة) ফেলে দেয়, এবং সেই হরকত টা প্রথম অক্ষরে (فاء كلمة ) দেয়। কিন্তু এই নিয় শুধুমাত্র শুধুমাত্র নামবাচক একবচন (فعل), উত্তমপুরুষে বহুবচন (فعلنا) এবং মধ্যম পুরুষে বহুবচন (فعلتم) এই তিন ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে খাটে, আয়াতে আলোচ্য আদেশবাচক অথবা নিষেধবাচকের ক্ষেত্রে খাটে না। এটা বলা যায়না যে: ظِلّ قائما ، ولا تظِلّ قائما। এজন্য যে قاف এর উপর যবরে কিরাতের ক্ষেত্রে আরবদের কথিতظلت এবং أحست দ্বারা দলীল পেশ করতে চায়, বর্ণিত কারণে তার সঠিকতা প্রমান হয়না। তবে আরবদের থেকে শ্রবন করে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে: ينحطن من الجبل যখন মূলে ছিল ينحططن। যদি এটা সঠিক হয় তবে, এই ক্বিরাআতের পক্ষে অন্য যে কোন পেশকৃত দলীলের থেকে এটা গ্রহনযোগ্য। “
অর্থাৎ: তাবারি এখানে ব্যকরগত কারনে ক্বাফের উপর যবর দিয়ে পড়ার চেয়ে ক্বাফের নিচে জের দিয়ে পড়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর ক্বাফের নিচে যের দিয়ে পড়লে এই আয়াতের অর্থ হবে এই যে এই আয়াতটি নবী পত্নিদের অথবা মহিলাদের নিজেদের গৃহে প্রশান্তিদায়ক আচরন করতে বলেছে। অন্য ভাবে বললে কুররাতু আ’ইয়ুন হয়ে চলতে বলেছে। এখানে ক্বুররাহ এর শব্দমূল এবং وقرن এর শব্দমূল একই হতে পারে সেটা ব্যাসিক গ্রামার থেকেই বোঝা যায়। তবে ইমাম তাবারির একাডেমিক আচরন খুবই লক্ষনীয়। উনি অন্য মতামতকে এখানে একেবারে বাতিল করেন নাই, বরং সেই মতের পক্ষে অধিকতর গ্রহনযোগ্য একটা যুক্তিও উল্লেখ করেছেন।
তাবারির এই ব্যাখ্যা এবং অনুবাদ শায নয়। এই মতামত শুধু তাবারির নয়, বরং পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের অধিকাংশেরই ছিল। যেমন দেখা যায়, প্রখ্যাত মুফাসসির ইয়াহইয়া ইবনে আব্দিস সালাম (২০০ হি.) এই মতামত রাখতেন। (২) আবু উবায়দাহ মা’মার ইবনুল মুছান্না (২০৯ হি.) নামের পূর্ববর্তী এক মুফাসসির ক্বাফ এর উপর জবর এবং অবস্থান (القرار) অর্থের ক্বিরাআতকে তার শায়েখদের দলীল দিয়ে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। (৩) ব্যাকরনবিদ আবু উছমান মাযিনি (২৪৭ হি.) এবং আবু হাতিম (৩২৭ হি.) উভয়েই ক্বাফ এর উপর জবর দিয়ে القرار বা অবস্থান অর্থে পড়তে ব্যকরনগত কারনে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ৩৭৩ হিজরীতে মারা যাওয়া তাফসীরে বাহরল উলুমের লেক ‘আলি বিন ইয়াহইয়া সমরকন্দি এর মতে এর আয়াতের وقرن হলো وقار বা গাম্ভীর্য, প্রশান্তি বা মর্যাদা এর অর্থে ব্যবহৃত হবে। (৪) ইমাম বাগাভি তার মা’আলিমুত তানযিলে (৫১৬ হি.) তে দ্বিতীয় অর্থকেই অধিক সহীহ বলেছেন। (هو الأصح أنه أمر من الوقار)। (৫) অর্থাৎ তার কাছে উপরোক্ত ক্রিয়ার মূল হলো وقار বা প্রশান্তি।
এছাড়া পঞ্চম শতাব্দির আগ পর্যন্ত কোন মুফাসসির প্রশান্তি/وقار অর্থকে নাকচ করেছেন বলে আমার চোখে পড়েনাই। এ সময় পর্যন্ত এই আয়াতের ব্যাখ্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যকরন এবং ব্যকরনের আলোচনায় প্রশান্তি অর্থই প্রাধান্য পায়। প্রখ্যাত মুফাসসিরকারক ছা’লাবি (৪২৭ হি.) প্রথম ব্যাকরনের ব্যাখ্যার পাশাপাশি আছারের দিকে নজর দেন। এ ক্ষেত্রে এই আয়াত পড়ে আয়েশা রা: এর ক্রন্দন এবং আম্মার রা: এর আয়েশা রা: কে ঘরে অবস্থানের তাগিদ দিয়ে তিনি ইঙ্গিত দেন যে ঘরে অবস্থান এই আয়াতের একটি অধিক গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে। (৬) আন্দালুসের প্রখ্যাত আলেম ও মুফাসসির ইবনে ‘আতিয়্যাহ (৫৪২ হি.), ফখরুদ্দিন রাযি (৬০৬ হি.) তাদের তাফসিরে قرار বা ঘরে অবস্থানকে প্রধান অর্থ হিসেবে গ্রহন করা শুরু হলে পরবর্তী মুফাসসিররা এর উপরেই জোর দিতে শুরু করেন। উদাহরন স্বরুপ: ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি.) এর উপর ভিত্তি করে এই আয়াতকে নারীদের ঘরে অবস্থানের অন্যতম দলীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি যুক্তি দেখান যে: এই আয়াত যদিও শুধুমাত্র নবী পত্নীদের উদ্দেশ্যে বর্ণিত এই আয়াত সমস্ত মহিলার উপরও প্রযোজ্য হবে। এজন্য অত্যন্ত জরুরত বাদে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত হবেনা। তিনি এটাও দেখান যে জটিল তা'লিল করে দুই ক্বিরাত থেকেই ক্বারার বা অবস্থানের অর্থ নেয়া সম্ভব। (৭) বর্তমানে আমরা নবী পত্নিদের সম্বোধন করে নাযিলকৃত এ আদেশের ক্ষেত্রে সাধারন নারীদের যোগ করার যে মনস্তত্ব দেখি তা মূলত: ইমাম কূরতূবী রহ. এর এই তাফসির থেকে শুরু হয়। আন্দালুসের আরেক মুফাসসির ইবনে হাইয়্যান (৭৪৫ হি.) ভাষাগত দিক থেকেও القرار বা অবস্থানের মতামতের পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাফসিরে ইবনে কাছিরেও (৭৭৪ হি.) কোন শরয়ী প্রয়োজন বাদে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়। এর পরবর্তীতে মূলক কেউ অন্য অর্থের সম্ভাব্যতাকে প্রধান্য দেননি এবং সেরকম চিন্তাও করেন নি। তখন থেকেই মূলত এ্ই আয়াত কে সাধারন নারীদের জন্য উপযোগি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
পর্যবেক্ষন:
১. এখন কোন অর্থ প্রাধান্য পাবে এই আলাপে আমার কোন আগ্রহ নাই। আমার প্রশ্ন হলো কেউ যদি وقرن في بيوتكن এর তোমরা ঘরে প্রশান্তি বজায় রাখো আর বাইরে বের হলে জাহেলি যুগের মত প্রদর্শনি কইরোনা- অনুবাদ করে তাহলে তার সাথে আমাদের আচরন কি হবে? আমরা কি তাকে ফেমিনিস্ট বলবো? আমরা কি তাকে বিদ’আতি, ভ্রান্ত, শায মতামত গ্রহনকারী বলবো ? নাকি এটাকে স্বাভাবিক ন্যয়সঙ্গত ইখতিলাফের মধ্যেই ধরে নেব।?
২. যুগের পরিবর্তনে ডমিনেন্ট/গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা পাল্টায় যায়। এজন্যই মুতাকাদ্দিমিন এবং মুতাআখখিরীনদের মাসআলায় ভিন্নতা পাওয়া যায়। এভাবেই এক সময় যে মিলাদ ক্বিয়াম ছিলনা তা নিয়ে আজকে আমাদের তর্ক করতে হয়। এক সময় আল্লাহ কোথায় এ নিয়ে কালামি বিতর্ক ছিলনা, আজকেও এই প্রশ্নও আক্বীদার অন্যতম অংশ হয়ে গেছে। এজন্য আবেগ বা নাকচের তাড়না থেকে কোন কিছু বাদ করার আগে তুরাছ পড়ে-শুনে বাদ করা উচিত। সাধারনত মানদন্ড হওয়া উচিত তুরাছের গ্রহনযোগ্য আলেমদের মতামত। আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত তুরাছি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আধুনিকতাকে প্রতিহত করার তাড়না এবং তুরাছ বিষয়ে অজ্ঞতা থেকে যেন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত না আসে খেয়াল রাখতে হবে।
উদাহরণ স্বরুপ قوام শব্দের ব্যাখ্যায় ফেমিনিজম প্রতিহত করতে অনেকেই ইদানিং ক্ষমতা/আধিপত্যের অর্থ আনছেন, সে হিসেবে তুরাছি অর্থের কথা যারা বলেন তাদেরকে খারাপ বিশেষনে অভিহিত করার কাহিনিও ঘটছে। এই শব্দ নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত আলাপের ইরাদা রাখি। ইনশাআল্লাহ।
............................
১. https://quran-tafsir.net/tabary/sura33-aya33.html#tabary
২. https://quran-tafsir.net/zamanen/sura33-aya33.html
৩. https://quran-tafsir.net/taalaby/sura33-aya33.html
৪. https://quran-tafsir.net/samarqandy/sura33-aya33.html
৫. https://quran-tafsir.net/baghawy/sura33-aya33.html